স্বদেশবিচিত্রা আরও ডেস্ক : বর্তমান যুগের হোটেল ও রেস্টুরেন্টে বুফে খাবারের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে। এ খাবারের নিয়ম হলো, হোটেল কর্তৃপক্ষ একটি বড় পাত্রে বিভিন্ন ধরনের খাবার রেখে নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে ক্রেতাকে সেখান থেকে ইচ্ছামতো খাওয়ার অনুমতি দেয়। এ ক্ষেত্রে মূল্য নির্দিষ্ট, তবে পণ্য অনির্দিষ্ট। অনেক সময় খাবারের ধরন ও পরিমাণ সবই অনির্দিষ্ট।
এ পদ্ধতিতে ক্রয়-বিক্রয় ইসলামী আইনের আলোকে বৈধ হওয়ার কথা নয়। কারণ চুক্তির সময় পণ্যটি এমন অস্পষ্ট, যার ভেতর ‘ধোঁকা’ আছে। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন ধোঁকাপূর্ণ লেনদেন করতে নিষেধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাদের প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় করতে এবং কাঁকর নিক্ষেপে ক্রয়-বিক্রয় নির্ধারণ করতে নিষেধ করেছেন।
(তিরমিজি, হাদিস : ১২৩০)
তবে বুফে খাবারের ক্ষেত্রে মানুষ কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই এমন লেনদেন করছে। আর এ ধরনের ধোঁকা ক্ষমাযোগ্য। কেননা, ফুকাহায়ে কিরাম এ ব্যাপারে একমত যে সাধারণ ধোঁকা চুক্তিকে নষ্ট করে না। আর যে সমাজে যার ব্যাপক প্রচলন ঘটে গেছে এবং তা নিয়ে কেউ বিবাদ করে না; এমন ধোঁকা সহনীয় ও ক্ষমাযোগ্য।
আল্লামা দুসুকি (রহ.) সাধারণ ধোঁকার সংজ্ঞায় বলেছেন—‘সাধারণ ধোঁকা হলো যতটুকু পরিমাণকে মানুষ ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে।’
ইমাম নববী (রহ.) বলেছেন, ‘ওলামায়ে কিরাম বলেছেন, ক্রয়-বিক্রয় বাতিল হওয়ার মূল ভিত্তি হলো ধোঁকা।’ আর ধোঁকা অবস্থায় চুক্তি সহিহ হওয়ার ক্ষেত্রটি হলো, যদি ধোঁকার আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন হয় এবং কষ্ট ছাড়া তা থেকে বাঁচা না যায় এবং ধোঁকাটি সামান্য হয়, তাহলে ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ, অন্যথায় জায়েজ নেই।
আলোচ্য (বুফে খাওয়া) মাসআলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মাসআলা হলো- ভাড়ার বিনিময়ে গণ-গোসলখানায় প্রবেশ করা। এটি ফুকাহায়ে কিরামের দৃষ্টিতে বৈধ।
অথচ চুক্তির সময় এটি জানা যায় না যে কী পরিমাণ পানি ব্যবহার করবে এবং কত সময় ব্যবহার করবে? আর পানি ব্যবহারে মানুষের অভ্যাসের ভিন্নতা থাকার পরও তার সেচ বিক্রয় করা জায়েজ। ইমাম নববী (রহ.) এ মাসআলাগুলো আলোচনা করেছেন।
বুফে খাবারের নিকটতম দৃষ্টান্ত হলো খাবার ও পোশাকের চুক্তিতে স্তন্যদানকারিণী নিয়োগ দেওয়া। আল্লামা জাসসাস (রহ.) বলেছেন, সন্তানের পিতা যথাযথভাবে তাদের খাবার ও পোশাক দেবে—এ আয়াতে খাবার ও পোশাকের বিনিময়ে দুগ্ধদানকারিণী নারী নিয়োগ করা জায়েজ হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। কারণ আল্লাহ তাআলা তালাকপ্রাপ্তার জন্য যে দুটি জিনিস আবশ্যক করেছেন, সে দুটি হয়েছে দুগ্ধপানের বিনিময়। মহান আল্লাহ এ বাণীর মাধ্যমে এটি স্পষ্ট করেছেন—‘তারা যদি তোমাদের সন্তানদের দুগ্ধপান করায়, তাহলে তাদের পারিশ্রমিক দাও।’ (আল-মাজমু শারহুল মুহাজ্জাব, পরিচ্ছেদ : ধোঁকা ও অন্যান্য নিষিদ্ধ বিক্রয়… খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা-২৫৮)
ইমাম সারাখসি (রহ.) বলেছেন, খাবার ও পোশাকের বিনিময়ে ধাত্রী নিয়োগ দেওয়া শাফেয়ি মাজহাব ও ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর মতানুযায়ী জায়েজ নেই। কারণ খাবার ও পোশাক অস্পষ্ট বস্তু। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) জায়েজ বলেছেন। এরপর ইমাম সারাখসি (রহ.) বলেছেন—
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ‘সন্তানের পিতা যথাযথভাবে তাদের খাবার ও পোশাক দেবে’—এ আয়াতের মাধ্যমে দলিল দেন যে তালাকের পর দুধ পান করানোর পারিশ্রমিক হিসেবে এই খাবার ও পোশাক দেওয়া হবে।
আর ইসলামী আইনজ্ঞরা ধাত্রীকে পরিবারের সদস্যের মতো মনে করে। আর ধাত্রীর খাবার ও পোশাকের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় না; বরং সামর্থ্য অনুযায়ী দেবে—যেমন স্ত্রীর খাবার ও পোশাকের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় না। প্রত্যেকে সামর্থ্য অনুযায়ী দেবে।
এ বিষয়ে ইমাম ইবনে কুদামা (রহ.) বলেছেন, খাবার ও পোশাকের চুক্তিতে কোনো শ্রমিক নিয়োগ দিলে অথবা তার পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে তার খাবার ও পোশাকের শর্ত করলে সে ব্যাপারে ইমাম আহমাদ (রহ.) থেকে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। জায়েজের পক্ষে তাঁর একটি বর্ণনা আছে। এটি ইমাম মালেক ও ইসহাক (রহ.)-এর মাজহাব। আবু বকর, উমর ও আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, খাবার ও পোশাকের বিনিময়ে তাঁরা শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন। ইমাম আহমাদ (রহ.) থেকে অন্য একটি বর্ণনা রয়েছে যে শুধু ধাত্রীর ক্ষেত্রে এমন চুক্তি করা জায়েজ, অন্যের ক্ষেত্রে জায়েজ নেই। আল্লামা কাজি (রহ) এটি গ্রহণ করেছেন এবং এটি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মাজহাব। কারণ ওই দুটি অনির্দিষ্ট। তবে আল্লাহ তাআলার বাণী, ‘সন্তানের পিতা যথাযথভাবে তাদের খাবার ও পোশাক দেবে’—এ কারণে তিনি ধাত্রীর ক্ষেত্রে তা জায়েজ বলেছেন। সুতরাং দুধ পান করানোর বিনিময় হিসেবে তাদের জন্য খাবার ও পোশাক আবশ্যক করেছেন। তালাকপ্রাপ্তা ও অন্যদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেননি; বরং আয়াতে এমন একটি বিষয় আছে, যা তালাকপ্রাপ্তা হওয়া প্রমাণ করে। কারণ স্ত্রী দুধ পান না করালেও তার খরচ ও পোশাক পায়। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘ওয়ারিশদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধান।’ আর ওয়ারিশ তো স্বামী নয়। তা ছাড়া দুধ পান ও সন্তান প্রতিপালনের উপকারিতা অনির্দিষ্ট। সুতরাং তার বিনিময়ও অনুরূপ অনির্দিষ্ট হওয়া জায়েজ।
মূল কথা হলো ফুকাহায়ে কিরামের বক্তব্য থেকে জানা যায়, কোনো কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে মুক্ত রাখার ব্যাপারে সামাজিক প্রচলনের বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। আর বুফে খাবারের ক্ষেত্রে যে প্রচলন ঘটেছে, তা এ ধরনের হওয়ার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ জনগণ এগুলোর লেনদেন করছে এবং খাবারের পরিমাণ নিয়ে যে অস্পষ্টতা আছে, তা নিয়ে কেউ বিবাদ করছে না। তাই এটি জায়েজ।
বুফে খাবারের নিয়ম হলো ক্রেতাকে ইচ্ছামতো খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, খাবার নিয়ে যাওয়া বা অন্য কাউকে খাওয়ানোর অনুমতি দেওয়া হয় না। সুতরাং এখানে প্রাথমিক পর্যায় বৈধ এবং শেষ পর্যায় মালিক সাব্যস্ত করার বিষয়টি স্পষ্ট। তবে শুধু খাওয়ার সময়ই মালিকানা পাওয়া যায়। অতএব, কেউ যদি খাওয়ার জন্য খাবার নেওয়ার পর তা না খায়, তাহলে তার হুকুমটি প্রচলিত নিয়মের ওপর মওকুফ থাকবে। সুতরাং যেখানে প্রচলিত নিয়ম থাকবে যে ওই খাবার পাত্রে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না, সেখানে ক্রেতা মালিক হবে। আর যেখানে পাত্রে ফিরিয়ে দেওয়ার নিয়ম আছে, সেখানে ক্রেতা মালিক হবে না।
শেষ কথা হলো, প্রচলিত নিয়মে বুফে খাওয়া বৈধ।
-ফিকহুল বুয়ু থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছেন মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
স্বদেশবিচিত্রা/এআর