শুক্রবার, ১৫ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩১শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নুহ (আ.)-এর প্রলয়ের পর পুনর্গঠিত সভ্যতা

নিউজটি শেয়ার করুন

স্বদেশবিচিত্রা আরও ডেস্ক : মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা নুহ (আ.)। তিনি আদম (আ.)-এর পর মানুষের প্রতি প্রেরিত প্রথম নবী ও ‘উলুল আজম রাসুল’। কোরআনে ৪৩ বার নুহ নামটি এসেছে। সৃষ্টির প্রভাতকালে মানুষ এক আল্লাহর ইবাদত করত।

আল্লাহর ওপর বিশ্বাসে অবিচল ছিল। কিন্তু একসময় শয়তানের প্ররোচনায় তারা একাত্ববাদ থেকে সরে আসে। আল্লাহকে ভুলে যায়। শুরু করে মূর্তিপূজা।

এভাবে অবিশ্বাসের অন্ধকারে কেটে যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী। অন্ধকারে আলোর রেখা হয়ে আসেন নুহ (আ.)। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি নুহকে তার জাতির কাছে পাঠিয়েছি।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৫৯)

নুহ (আ.)-এর সম্প্রদায় ছিল সত্য গ্রহণের ব্যাপারে অন্ধ ও মন্দ এক জাতি।

সবাই মূর্তিপূজা করত। তারা দুর্বলদের প্রতি অত্যাচার করত। কুফরি ও মিথ্যাচার করত। পাপ করত। নুহ (আ.) তাদের সত্য পথে আহ্বান করলেন।

সত্য ধর্মের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তারা সাড়া দিল না। ঘৃণা ও অবজ্ঞার সঙ্গে তাঁকে অস্বীকার করল। (কাসাসুল কোরআন, মাওলানা হিফজুর রহমান, অনুবাদ : আব্দুস সাত্তার আইনী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৭)

যেসব দরিদ্র ও দুর্বল লোক ঈমান এনেছিল, তাদের নিয়ে মশকরা করত। ঠাট্টা করে বলত কটু কথা। তাদের সেসব কথা কোরআনে বাঙ্ময় হয়েছে এভাবে, ‘তখন তাঁর জাতির কাফির নেতারা বলল, যারা অবিশ্বাসী ছিল তারা বলল, আমরা তোমাকে আমাদের মতো মানুষ ছাড়া অন্য কিছু দেখছি না, আর বাহ্যত আমাদের হীন অধম লোকগুলো ছাড়া তোমার পথ অবলম্বন করতে দেখছি না, আমাদের ওপর তোমার কোনো প্রাধান্যও দেখছি না, বরং আমরা তোমাদের মিথ্যুক বলেই মনে করি।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ২৭)

নুহ (আ.) ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত পাওয়ার পর দাওয়াতি কাজ অব্যাহত রাখেন। সাড়ে ৯০০ বছর স্বজাতিকে একত্ববাদের দাওয়াত দেন। গুটিকয়েক লোক ছাড়া কেউ ঈমান আনেনি। অবিশ্বাসীরা তাঁর ওপর অত্যাচর করত। দুর্ব্যবহার করত। বদ্ধ উন্মাদ বলে বেড়াত। কখনো মাটির ওপর শুইয়ে গলা চেপে ধরত। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, মাওলানা মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলভি, অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল ফারুক, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৩১৪ ও ৩২৩)

নুহ (আ.) অবিশ্বাসীদের আজাবের ভয় দেখালেন। তারা নবীর কথা কলহ ও বিবাদ মনে করল। বলল, আজাব নিয়ে আসুন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা বলল, হে নুহ, আমাদের সঙ্গে আপনি তর্ক করেছেন এবং অনেক কলহ করেছেন। এখন আপনার সেই আজাব নিয়ে আসুন, যে সম্পর্কে আপনি আমাদের অঙ্গীকার দিয়েছেন; যদি আপনি সত্যবাদী হন।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৩২)

আল্লাহ তাআলা নুহ (আ.)-কে জানালেন, ‘আর কেউ ঈমান আনবে না। আপনি নৌকা তৈরি করুন।’ নুহ (আ.) আল্লাহর তত্ত্বাবধানে নৌকা তৈরি শুরু করলেন। জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে পেরেক ঠুকে নৌকা বানালেন। লোকেরা সেসময় বেশ উপহাস করত। বলত, নদী বা সমুদ্রবিহীন জায়গায় পাগল ছাড়া কেউ নৌকা বানায়! নবী ধৈর্য ধরে বলতেন, একদিন আমিও উপহাস করব।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৩৮)

চুলা থেকে পানি উথলে উঠল একদিন। নুহ নবী বুঝলেন, মহাপ্লাবন শুরু হয়ে যাচ্ছে। তাঁকে আল্লাহ এমনটিই জানিয়ে ছিলেন আগে। তিনি পরিবার-পরিজন, বিশ্বাসী মানুষ ও স্থলের প্রাণীদের থেকে এক জোড়া করে নৌকায় তুললেন। জমিনের বুক চিড়ে প্রবলবেগে পানির ফোয়ারা বয়ে গেল। অজস্রধারায় ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত হলো জলপ্রপাত। আসমান থেকে মুষলধারে বর্ষিত হতে থাকে পানি। তীব্র গতিতে শুরু হয় ঝড়-তুফান। পাহাড়সম উঁচু ঢেউ তলিয়ে দেয় পৃথিবীর সব। জমিন ও আসমানের পানি এক হয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে মহাপ্লাবন। পৃথিবীর কানায় কানায় ভরে ওঠে পানি। গ্রাস করে নেয় সব কিছু। অবিশ্বাসী ডুবে মরে। এমনকি ডুবে মরে নুহ নবীর অবিশ্বাসী স্ত্রী ও ছেলে কেনান। শুধু বেঁচে যায় নৌকায় আশ্রয় নেওয়া বিশ্বাসীরা। (সুরা : হুদ, আয়াত : ৪০-৪২; নুহ আ. ওয়া কওমুহু ফিল কোরআনিল মাজিদ, আল-মাইদানি, পৃষ্ঠা-২৩)

বিশ্বগ্রাসী মহাপ্লাবন একসময় থেমে যায়। নৌকা থামে জুদি পর্বতে। নুহ (আ.) বিশ্বাসীদের নিয়ে নতুন পৃথিবীতে বসবাস শুরু করেন। শুরু হয় নতুন বা দ্বিতীয় সভ্যতার যাত্রা। তিনিই দ্বিতীয় মানবসভ্যতার ইতিহাসের জনক। মানুষের দ্বিতীয় পিতা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(নুহের বানের) পানি যখন কূল ছাপিয়ে সীমা ছাড়িয়ে গেল, তখন আমি তোমাদেরকে চলন্ত নৌযানে আরোহণ করালাম। যেন এ ঘটনাটিকে আমি তোমাদের জন্য শিক্ষাপ্রদ স্মারক করে রাখি আর সংরক্ষণকারী কান তা সংরক্ষণ করে।’ (সুরা : হাক্কাহ, আয়াত : ১১-১২)

এ আয়াতের ব্যাখায় মুফাসসিররা বলেন, নুহ (আ.)-এর সঙ্গে যাদের নৌযানে আরাহণ করানো হয়েছিল, তারাই হলো মানবজাতির মূল। নুহ (আ.) থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আসা সব মানুষই তাদের থেকে নির্গত বংশধর। [নুহ (আ.) ও মহাপ্লাবন, ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি, পৃষ্ঠা-৫৭৯]

মহাপ্লাবন-পরবর্তী পৃথিবীর সব মানুষ নুহ (আ.)-এর সন্তান। তাঁরই বংশধর। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর বংশধরকেই আমি বিদ্যমান রেখেছি বংশপরম্পরায়।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ৭৭)

প্রশ্ন হতে পারে, মহাপ্লাবন থেকে যারা মুক্তি পেয়েছিল, তাদের মধ্যে যেমন—নুহ (আ.)-এর সন্তানরা ছিল, অন্য মানুষরাও ছিল। পরে তাদের বংশবিস্তার হওয়াও স্বাভাবিক। তাহলে অবশিষ্ট সবাই যে নুহ (আ.)-এর বংশধর ছিল—এ কথা বলা কিভাবে সম্ভব? ইসলামিক স্কলাররা বলেন, নুহ (আ.)-এর বংশই জীবিত ছিল। আদম (আ.)-এর পর তিনিই মানবজাতির পিতা। [কিসসাতু নুহ (আ.), উমর ঈমান আবু বকর, পৃষ্ঠা-২৩]

ইবনু জারির (রহ.) বলেন, নুহ (আ.)-এর সঙ্গে নৌকায় তাঁর ওপর ঈমান আনয়নকারী একদল অনুসারী ছিলেন বটে, তবে তাঁরা কোনো উত্তরসূরি না রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে যারা পৃথিবীতে আছে, তারা সবাই নুহ (আ.)-এর বংশধর। (তারিখুত তাবারি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৭১)

জুদি পাহাড়ে নুহ (আ.)-এর নৌকা থেমেছিল। তিনি বিশ্বাসীদের নিয়ে প্রথমে বসতি গড়ে তোলেন হাররান নগরীতে। কিছু বর্ণনামতে, ‘নুহ (আ.) বিশ্বগ্রাসী প্লাবনের পর নৌকা থেকে নেমে সর্বপ্রথম দুটি জনপদের গোড়াপত্তন করেন। প্রথমে তিনি হাররান নগরী এবং এরপর দামেস্ক নগরী গড়ে তোলেন।’ (দেশ-দেশান্তর, মুফতি মুহাম্মাদ তকি উসমানি, অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল ফারুক, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩০৩)

নুহ (আ.)-এর মৃত্যুর সময় জানা যায়নি। কোরআনে এসংক্রান্ত কোনো আলাপ নেই। বলা হয়ে থাকে, তাঁকে মসজিদে হারামে দাফন করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তাঁকে তাঁর অঞ্চল বা কারাক নুহে দাফন করা হয়েছে। [উলুল আজমি মিনার রুসুলি নুহ (আ.), আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ, পৃষ্ঠা-৪৯]

-লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

স্বদেশবিচিত্রা/এআর