বৃহস্পতিবার, ৩রা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা

নিউজটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে এক গভীর ও বহুমাত্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম, অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্থবিরতা, মূল্যস্ফীতি ও ঋণখেলাপি বৃদ্ধির ফলে এ খাতের ওপর জনগণের আস্থা কমে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংকট শুধু আর্থিক খাতের নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতির স্বাস্থ্যের প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এক সময় ছিল জাতীয় অর্থনীতির অগ্রযাত্রার অন্যতম চালিকা শক্তি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই খাত চরম অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অপেশাদার ব্যবস্থাপনার কারণে এক গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে শুরু করে বেসরকারি ও ইসলামী ব্যাংকগুলো—সবক্ষেত্রেই অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণ, অর্থপাচার, খেলাপি ঋণ এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে একদিকে ব্যাংকিং ব্যবস্থা হারাচ্ছে জনআস্থা, অন্যদিকে সামগ্রিক অর্থনীতি পড়ছে চরম চাপে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা মূলত ধরা পড়ে ২০১০-এর পর থেকে, যখন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি ব্যাংকে একের পর এক বড় ধরনের কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ পেতে থাকে। হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা তখন পুরো জাতিকে হতবাক করে। এগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল ঋণের অনুমোদনে নিয়মবহির্ভূত হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক অনুগ্রহভোগীদের ঋণ দেওয়া এবং ঋণ আদায়ে কোনো রকম কার্যকর উদ্যোগের অভাব।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে এক জটিল ও সংকটপূর্ণ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক সময়ের সম্ভাবনাময় ও প্রবৃদ্ধিশীল এই খাত আজ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে আস্থাহীনতার শিকার হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আর্থিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ এ স্তম্ভে একদিকে রয়েছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অন্যদিকে দুর্নীতির বিস্তার ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব। এর ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি অস্থির হয়ে উঠেছে এবং সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারী পর্যন্ত সবাই শঙ্কিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছেন।

এই বাস্তবতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর উল্লেখ করেছেন, “অর্থনীতি খারাপ হয়ে পড়লে সরকারের পতন হয়। বাংলাদেশেও তা–ই হয়েছে।” তাঁর মতে, অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, দুর্নীতি এবং ভোটাধিকার হরণের কারণে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাসহীনতা তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “বিস্ফোরণোন্মুখ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। টাকা ছাপানো বন্ধ, সঙ্গে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিও বন্ধ করা হয়েছে।” এর মাধ্যমে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক চরম সংকটের মধ্যেও এক ধরনের স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, “মানুষের ক্ষোভ ও কষ্ট কমাতে পারলে সেটাই হবে বড় অর্জন।” তাঁর মতে, টাকা ছাপিয়ে সাময়িক স্বস্তি আসলেও সেটি স্থায়ী সমাধান নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাই কঠোর নীতিমালার দিকে ঝুঁকেছে, যার মধ্যে রয়েছে অন্য ব্যাংক থেকে দুর্বল ব্যাংককে সাহায্য করা এবং বিনিয়য় হার স্থিতিশীল রাখা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগকে সমর্থন করে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, সেগুলো ঠিক আছে। তবে শিল্পের কথা ভাবা হয়নি।” তাঁর মতে, যেসব ব্যবসায়ী ৯ শতাংশ সুদে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করেছেন, তাঁরা এখন ১৫ শতাংশ সুদের মুখোমুখি হচ্ছেন। এই অবস্থায় বিনিয়োগকারী কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন, সে বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের আরও সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।
সুদহার বৃদ্ধির ফলে শিল্পক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মন্তব্য করেন ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান রোমো রউফ চৌধুরী। তিনি বলেন, “১৫ শতাংশ ব্যাংকসুদে শিল্পকারখানা করে সফল হওয়া কঠিন।” এ বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তাঁর মতে, “সুদহারের সঙ্গে বিনিয়োগের সম্পর্ক তেমন একটা দেখা যায় না।” তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে নীতিগত উদারতা থাকলেও দুর্বৃত্তায়নের কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যায়নি।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর স্বীকার করেন, “৬-৯ শতাংশ সুদহার করেও বিনিয়োগ বাড়ানো যায়নি।” তাঁর মতে, অর্থনীতির সামষ্টিক স্থিতিশীলতা না এলে বিনিয়োগ বাড়বে না। এ জন্য সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে বেসরকারি খাতকে ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি। বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন বলেন, “বর্তমানে যে খেলাপি ঋণের কথা বলা হচ্ছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে।” একইসঙ্গে বিআইবিএমের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত খেলাপিদের মধ্যে পার্থক্য করার ওপর জোর দিয়ে বলেন, “ইচ্ছাকৃত খেলাপি খারাপ। তাঁদের জেলে নিতে হবে।”
এ প্রসঙ্গে মো. আহসান হাবীব বলেন, “খেলাপি ঋণ বেশি হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঋণ থেকে। এই বাণিজ্যেই ৭০-৮০ শতাংশ জালিয়াতি ও অর্থ পাচার হয়।” ব্যাংক এশিয়ার রোমো রউফ চৌধুরী আরও বলেন, “আমরা যেসব প্রতিষ্ঠানকে অর্থায়ন করি, তাদের বেশির ভাগই ঋণ ফেরত দিতে নানা সমস্যায় পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারণে কর্মমূল্যায়ন বিবেচনায় ব্যাংকে চাকরিচ্যুত করা যায় না।” তিনি ব্যাংক মালিকানায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার বলেন, “রাজনৈতিকভাবে কেউ কেউ এমন সুবিধা পেতেন যে আমরা প্রতিযোগিতা সক্ষম থাকতাম না। একটি পরিবার আট-নয়টি ব্যাংকের মালিকানা পেয়েছে। সেটি কীভাবে সম্ভব?” ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান বলেন, “রাজনৈতিক কারণে কিছু ভালো ব্যাংক দুর্বল হয়েছে। একটু সহায়তা দিলে কিছু ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে।”
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “৪–৫টি পরিবার ব্যাংক থেকে ২ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এতে অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসতে পারত, সেটা হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করলে ছয় মাস পর শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হয়ে যাবে।”
ব্যাংক খাতের দুর্বলতা জনআস্থার ওপর প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুশাদ ফরিদী। তাঁর ভাষায়, “মানুষের মনে একধরনের ভীতি আছে। অনেকেই জানতে চান, কোন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ?” তিনি বলেন, “রুগ্‌ণ ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হলে ভালো ব্যাংকেও তার প্রভাব পড়ে।”
ব্যাংক কোম্পানি আইন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ইস্টার্ণ ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার। তিনি বলেন, “আইনটি রাতের আঁধারে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি আরও সংশোধন করে সমৃদ্ধ করা যায়।” তাঁর মতে, দুর্বল ব্যাংকে বিনিয়োগ করলে বিদেশি ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছে ব্যাখ্যা দিতে হয়, যা অত্যন্ত বিব্রতকর।
লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের এমডি হুমায়রা আজম বলেন, “পরিচালনা পর্ষদ ভালো হলেও যদি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দুর্বল হয়, তাহলে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।” তিনি বলেন, “এতগুলো ব্যাংকে লুটপাট হয়ে গেল, সেখানে এমডিরা কী করেছেন? তাঁদের সততা কোথায় ছিল?” তাঁর মতে, কিছু ব্যাংকের জন্য কয়েক বছরের জন্য লভ্যাংশ বিতরণ বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
সংস্কার উদ্যোগ প্রসঙ্গে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমরা জানি সমস্যাগুলো কোথায়। এ জন্য তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে।” ইতোমধ্যে ১০-১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন করা হয়েছে এবং এসব ব্যাংকে আমানত বাড়ছে বলে তিনি দাবি করেন। তাঁর মতে, “এক বছর সময় দিলে এসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে।”
তিনি বলেন, “শেয়ার বিক্রি করে দুর্বল ব্যাংকের মূলধন সংগ্রহের পরিকল্পনা আছে। পাশাপাশি সরকার ও বিদেশি সংস্থার সহায়তায় ৫০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনাও রয়েছে।” তবে, সবশেষে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “রাজনীতি সংস্কার না হলে অর্থনীতির সংস্কার টেকসই হবে না।”
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে একটি টেকসই পথে ফিরিয়ে আনতে হলে কেবল অর্থনৈতিক নীতিমালা নয়, বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং কার্যকর আইন প্রয়োগ জরুরি। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃঢ় পদক্ষেপ, পেশাদার ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এবং নীতি নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি—এই তিন উপাদান ছাড়া এ খাত ঘুরে দাঁড়াবে না। সংকট গভীর, তবে সঠিক পথ অনুসরণ করলে সমাধান সম্ভব।