লিভার রোগজনিত মৃত্যু বিশ্বব্যাপী মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে পরিগণিত। লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে লিভারে চর্বি জমাজনিত প্রদাহ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস। অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়ার কারণে যকৃতে যে প্রদাহ সৃস্টি হয় তাকেই steatohepatitis বলা হয়। ফ্যাটি লিভারের বিপদজনক পরিনতি হচ্ছে ন্যাশ (NASH)। নির্ণয়হীন ও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ফ্যাটি লিভার বিপদজনকভাবে NASH-এর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। লিভারে প্রদাহ সৃস্টি করা ছাড়াও যকৃতে চর্বি জমার আরো বেশ কিছু খারাপ দিক রয়েছে। এই রোগটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং শরীরে ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। সারা বিশ্বের সাথে সাথে বাংলাদেশেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব আশংকাজনক হারে বাড়ছে।
ফ্যাটি লিভার এবং এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাপি ৮ম বারের মত ১২ জুন পালিত হয়েছে Global Fatty Liver Day। এ বছরের প্রতিপাদ্য “ACT NOW, SCREEN TODAY”।
সারা বিশ্বের সাথে এবারেও ৮ম Global Fatty Liver Day উদযাপন করার লক্ষ্যে হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ ১৯ জুন বৃহস্পতিবার ২০২৫ সকাল ১০ টায় সুপার-স্পেশালাইজড হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে “কম খাই হাঁটি বেশি, ফ্যাটি লিভার দুরে রাখি” শীর্ষক জনসচেতনতামূলক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ও হেপাটোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো: শাহিনুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল অধ্যাপক (ডা.) এ এস এম মতিউর রহমান (অব:) এবং প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বারডেম হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম আযম।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেশবরেণ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-পুষ্টিবিদ-বিজ্ঞানীরা এই বলে সকলকে সতর্ক করেন যে, ফ্যাটি লিভার বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগজনক জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদী লিভার প্রদাহের কারণ হিসেবে ভাইরাসকে অতিক্রম করে ইদানীং ফ্যাটি লিভার প্রাধান্য বিস্তার করছে।
বাংলাদেশে প্রতি তিন জনে এক জনের ফ্যাটি লিভার আছে। প্রায় চার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ ফ্যাটি লিভারে ভুগছে এবং এর মধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষ সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিতে আছে, অথচ প্রায় ক্ষেত্রে শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাস, হাঁটার অভ্যাস ও জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন এবং ওজন কমানোর মাধ্যমে ফ্যাটি লিভার ও ন্যাশ প্রতিরোধ করা যায়।
সাম্প্রতিক কালের এক গবেষনায় দেখা গেছে, যারা কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবার বিশেষত ভাত বেশি গ্রহণ করছে এবং সেই তুলনায় শারিরীক পরিশ্রম বা হাঁটা-চলাফেরা কম করছে, তাদের ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি। বাহিরের খাবার গ্রহণ, দিনে পাঁচ ঘন্টার উপরে যাদের বসে থাকতে হয় এবং একই সাথে কায়িক পরিশ্রম কম তাদের ঝুঁকি সবচাইতে বেশি।
হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা কর্তৃক বাংলাদেশে ফ্যাটিলিভার রোগ প্রতিরোধে কর্মপন্থা নির্ধারনে সুপারিশসমূহ:
১. প্রত্যেক ব্যক্তির সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন এবং প্রতিদিন অন্তত ত্রিশ মিনিট করে হাঁটতে হবে।
২. দড়ি লাফ এবং সাইকেল চালানো শরীরচর্চার জন্য ভাল।
৩. দুধ, ফল, শাক-সবজি খাওয়া বাড়ানো এবং চিনিযুক্ত খাবার, কোমল পানীয়, চকলেট, আইসক্রিম, ফাস্ট ফুড এবং (ভাজা খাবার) ট্রান্স-ফ্যাটের পরিমাণ কমানোর মাধ্যমে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ক্যালরি গ্রহণ কমাতে হবে।
৪. শরীরচর্চা বাড়ানো যায় এ রকম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রতিটি স্কুল এবং প্রশাসনিক ওয়ার্ডে খেলার মাঠ রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং প্রতিটি শিশুকে খেলতে এবং অন্যান্য শারিরীক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।
৫. মেইন রোডের পাশে বাইসাইকেল চালানো এবং হাটার জন্য আলাদা লেন তৈরি করা, যা স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি উভয়ের জন্য উপকারী হবে।
৬. গণ সচেতনতামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অধিক স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি এবং লবনযুক্ত জাংকফুড এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করতে উৎসাহিত করতে হবে।
৭. প্রক্রিয়াজাত খাবারের পুষ্টিমান সঠিক রাখার জন্য (উদাহরণ স্বরূপ, ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি এবং লবন পরিহার) খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের অধীনে আনতে হবে
৮. সফট ড্রিংক্সের পরিবর্তে ফ্রেস ফলের জুস এবং পানি পানকে উৎসাহিত করতে হবে। ছোট-বড় সবার জন্য পার্ক, খেলার মাঠ, স্কুল এবং কর্মস্থলে পরিস্কার পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে পুষ্টিমান এবং শক্তিমান (ক্যালরি) উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
১০. সকল চিকিৎসককে ফ্যাটি লিভার সংক্রান্ত পর্যাপ্ত জ্ঞান দিতে হবে, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠির দিকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে তারা ন্যাশের ঝুঁকিতে না পড়ে।
১১. ব্যবহার ও প্রয়োগ কমানোর জন্য (FAT Tax) ‘চর্বি বা চিনি কর’ ধার্য করার চিন্তা করা যেতে পারে।