রাজু আলীম : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই শুধু একটি সময়কাল নয়, বরং একটি সিম্বলিক অধ্যায়, যেখানে স্বপ্ন এবং বাস্তবতা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। “জুলাই সনদ” নামে পরিচিত ঘোষণাপত্রটি ছিলো গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তি, যার মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা এবং পুরনো শাসনব্যবস্থার অবসান নিশ্চিত করা হয়েছিলো। দেড় দশকের দুঃশাসন, দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে এই জুলাই সনদ আবির্ভূত হয়, যা একদিকে একটি স্বপ্নের প্রতিফলন, অন্যদিকে আগামীর কঠিন বাস্তবতার দিকনির্দেশনা।
স্বপ্নের দিক থেকে, জুলাই সনদ ছিলো বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি—যেখানে অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ দলীয়করণ থেকে মুক্ত হবে, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চেতনা এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের বাস্তব অভিজ্ঞতা মিলে এই সনদের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যায়।
জুলাই সনদের ঘোষণায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা দেশের জনগণকে নতুন আশার আলো দেখিয়েছে। এক দশকের রাজনৈতিক ক্লান্তি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের পর এই সনদ মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছে যে বাংলাদেশ আর কখনও ‘পথভ্রষ্ট’ হবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার এবং দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান সবকিছুই ছিলো জুলাই সনদের স্বপ্নের অংশ।
কিন্তু স্বপ্নের পাশাপাশি রয়েছে কঠিন বাস্তবতা। বাংলাদেশের ইতিহাসে ফ্যাসিস্ট চরিত্রে অবস্থান নেয়া আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় রাজনীতিতে একটি ফাঁকা জায়গাও সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি, এনসিপি এবং জামায়াত নিজেদের সাংগঠনিক ভাবে আরও ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এখানে আরও বেশি কাজ করা প্রয়োজন। এনসিপি নতুন প্রজন্মের উদ্দীপনা নিয়ে রাজনীতিতে এসেছে বটে, কিন্তু অভিজ্ঞতার ঘাটতি এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনের অভাব স্পষ্ট। বিএনপি দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কিছুটা সংকটে আছে, যদিও নির্বাচনের বাস্তবতা তাদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। জামায়াত ইসলামী, যারা আওয়ামী লীগের কারণে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলো, তারা ‘ইসলামী
গণতান্ত্রিক মডারেশনের’ কথা বললেও, জনগণের আস্থার জায়গায় পুরোপুরি পৌঁছাতে পারছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক মহলের চাপ এই তিনটি ফ্যাক্টরই আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট নির্ধারণ করবে। সরকারের জন্য এটি হবে এক কঠিন পরীক্ষা; তারা যদি সত্যিকার অর্থে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে, তবে জনগণের আস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। অন্যদিকে, যদি এই সরকারও ক্ষমতার রাজনীতির ফাঁদে পড়ে যায়, তবে ‘জুলাই সনদ’ আরেকটি ফাঁকা প্রতিশ্রুতির নাম হয়ে যাবে।
আর্থিক ব্যবস্থায়ও বাস্তবতা অত্যন্ত কঠিন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের ঋণ কেলেঙ্কারি, অর্থপাচার এবং কর্পোরেট দুর্নীতির কারণে অর্থনীতি গভীর সংকটে রয়েছে। জাতির উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে এ বিষয়ে কিছুটা আশার আলো দেখা যায়। ভাষণে অর্থনৈতিক সংস্কারের যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তবে প্রশাসনের মধ্যে এখনো পুরনো ব্যবস্থার ধারক ও বাহকরা সক্রিয়, যারা নিজেদের স্বার্থরক্ষায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।
তবুও, জুলাই সনদের মূল শক্তি হচ্ছে— জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। তরুণ প্রজন্ম, নাগরিক সমাজ, এবং প্রগতিশীল পেশাজীবীরা একটি নতুন বাংলাদেশ দেখতে চায়, যেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বদলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রাধান্য পাবে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং প্রতিষ্ঠানগত স্বচ্ছতা।
জুলাই তাই শুধুমাত্র একটি সময় নয়; এটি এক স্বপ্নের নাম, যা বাংলাদেশের জনগণকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সেই বাস্তবতা কঠিন, জটিল এবং প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই বাস্তবতাকেই জয় করতে হবে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ চাই।
বিএনপি, এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক ও সমঝোতামূলক দুই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিলীন হলেও, তাদের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রভাব এখনো প্রশাসনের গভীরে রয়ে গেছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে নিজেদের সুসংগঠিত করার পাশাপাশি ‘রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ’ প্রতিষ্ঠার দ্বৈত চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বিএনপি, দীর্ঘদিন ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফলে দমন-পীড়নে ভুগছিল, জুলাই সনদের মাধ্যমে তাদের জন্য এক নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচন হয়েছে। দলটি বর্তমানে এক ‘জাতীয় পুনর্গঠন সংকট’উত্তরণের নেতৃত্বের অবস্থানে রয়েছে। বিএনপির নেতৃত্ব বোঝে, একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক ভিশন, দক্ষ নেতৃত্ব এবং সংগঠনের পুনর্গঠনের মাধ্যমেই জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরাসরি রাজনৈতিক ময়দানে ফিরতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারেক রহমানের নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি বিএনপিকে শুধু আধুনিক, কৌশলগত ও সুসংহত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন এমনটি নয়। চাইছেন দেশ গড়ার ক্ষেত্রে আপামর মানুষের সম্পৃক্ততা। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যারা রাজনৈতিকভাবে হতাশ ও উদাসীন হয়ে পড়েছিল, তাদের সংগঠিত করাই তারেক রহমানের মূল ফোকাস। বিএনপি এখন মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করছে এবং তাদের দীর্ঘদিনের জোটরাজনীতি পুনর্বিন্যাসের কাজ করছে। তবে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আস্থার সংকট এখনো দলটির বড় চ্যালেঞ্জ।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে একটি ‘সিভিল মুভমেন্ট’ থেকে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এনসিপির মূল শক্তি হচ্ছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, নাগরিক সমাজ এবং তরুণ প্রজন্ম, যারা রাজনীতিতে হতাশ হয়ে একটি বিকল্প পথের খোঁজে ছিল। এনসিপি নিজেদের নতুন বিপ্লবি ধারা হিসেবে উপস্থাপন করলেও, তাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সংগঠন গড়ে তোলা এবং মাঠের রাজনীতিতে নিজেদের সক্রিয়তা নিশ্চিত করা। নেতৃত্বের অভিজ্ঞতার অভাব এবং তৃণমূল পর্যায়ে তাদের উপস্থিতি কম থাকায় এনসিপি এখনো জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনী রাজনীতিতে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারেনি। তবে জুলাই সনদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শূন্যতা তাদের জন্য একটি ‘ব্রেকথ্রু মোমেন্ট’, যেখানে তারা ধারাবাহিক সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে নিজেদের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে।
জামায়াতে ইসলামী, বিগত দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা ও সংগঠনের ভাঙনের মধ্যে ছিল, তারা নতুনভাবে নিজেদের পুনর্গঠনের কৌশল গ্রহণ করেছে। জামায়াত একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যেখানে তারা সরাসরি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে সামাজিক ন্যায়বিচার, নৈতিকতা এবং অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করছে। জামায়াতের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হলো তাদের পুরোনো অধ্যায়ের ইমেজ, যেটা দলটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর পথে একটি বড় বাধা। মাঠপর্যায়ে জামায়াত এখনো গ্রামীণ সমাজে তাদের সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করছে, এবং নির্বাচনী জোট রাজনীতিতে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে ‘ফ্লুইড অর্ডার’ বা ভাসমান শক্তির লড়াই চলছে, সেখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সরকার যদি জুলাই সনদের প্রতিশ্রুতি অনুসারে একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে, তবে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। কিন্তু প্রশাসনের মধ্যে থাকা পুরনো শক্তিগুলোর প্রতিরোধ, অওয়ামী অপরাজনীতি, দুর্বৃত্তায়িত অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর চাপ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার অভাব এই পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলতে পারে।
তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি পুনঃগঠনের চেষ্টা করছে, এনসিপি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জন করতে চাইছে এবং জামায়াত একটি পলিটিকাল ইসলামিস্ট প্ল্যাটফর্ম গঠনের চেষ্টায় আছে। তবে এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য এবং নেতৃত্বের মধ্যে দূরদর্শিতা। বাংলাদেশে সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখনও প্রতিহিংসার বৃত্তে আবদ্ধ। যদি দলগুলো নিজেদের সাংগঠনিক শক্তিকে জনগণের কল্যাণমুখী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রূপান্তর করতে পারে, তবে ‘জুলাই সনদ’ একটি কাগুজে ঘোষণা নয়, বাস্তবতার সফল রূপায়ণ হবে।জুলাই তাই শুধু একটি স্বপ্নের নাম নয়, এটি এক গভীর বাস্তবতার প্রতিশ্রুতি, যা আগামী দিনের বাংলাদেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি এবং সমাজব্যবস্থাকে নতুনভাবে নির্মাণ করতে পারে— যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজ এবং জনগণ সেই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসে।
রাজু আলীম,কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব