স্বদেশবিচিত্রা প্রতিবেদক : ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে গত বছরের ৫ আগস্ট সারা দেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করার আহ্বান জানিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আর সেইদিনই পতন হয় স্বৈরশাসক হাসিনার। ওই বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। তারপর থেকেই মানুষের মুখে চলে আসে ‘ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের’ কথা। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, আগামী বছরের (২০২৬ সাল) ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠানো হবে, যেন কমিশন আগামী রমজান মাস শুরুর আগে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এবার ফের আলোচনায় এসেছে কবে ভোটের তারিখ, নির্বাচনি রোডম্যাপ ও তফশিল? নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘নির্বাচনে অনুষ্ঠানের জন্য যেহেতু একটা সময়সীমা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু এবার আমরা আমাদের অ্যাকশনপ্ল্যান ঘোষণা করতে পারব। খুব শিগরিরই সেটি ঘোষণা করা হবে।’ খবর বিবিসি বাংলার।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা শুনেই রাজনৈতিক অঙ্গন আবারও চাঙা হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যেই সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে।
বুধবার ঢাকার গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ঘোষণাটি ‘ঐতিহাসিক। এ ঐতিহাসিক ঘোষণা বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠবে এবং গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে সুগম করবে।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরুর আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বুধবার নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, এ চিঠির মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো।
তবে বুধবার চিঠি পাওয়ার আগেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন জানান, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আমরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকলেও আমাদের প্রস্তুতি এগিয়ে যাচ্ছে।
গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন, ২০২৬ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে রমজান মাস শুরুর আগে।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি রোজা শুরু হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের মধ্যেই ভোট সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু ঠিক কত তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেটি জানা যাবে কবে? নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোটের আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য আগামী ছয় মাসে কী কী কাজ সম্পন্ন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে?
নির্বাচনি রোডম্যাপ কবে?
বাংলাদেশে প্রতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করতে দেখা যায় নির্বাচন কমিশনকে।
সাধারণত ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার অন্তত বছরখানেক আগে এ রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয় বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে এবার একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আয়োজন করতে হচ্ছে কমিশনকে। ফলে রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য খুব বেশি সময় তাদের হাতে নেই।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা এতদিন বলে আসছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সরকার ভোটের ব্যাপারে চূড়ান্ত সময়সীমা নির্ধারণ করতে না পারায় তারা রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারছেন না।
কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার সেই সংকট কেটে গেছে। তাহলে কবে ঘোষণা করা হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ?
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, নির্বাচনে অনুষ্ঠানের জন্য যেহেতু একটা সময়সীমা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু এবার আমরা আমাদের অ্যাকশনপ্ল্যান ঘোষণা করতে পারব। খুব শিগরিরই সেটি ঘোষণা করা হবে। ওই কর্মপরিকল্পনাতে কবে নাগাদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হবে এবং তফশিলের আগে-পরে কী কী কাজ সম্পন্ন করা হবে, সেটি উল্লেখ করা হবে।
এক্ষেত্রে তফশিল ঘোষণার পূর্বে ভোটার তালিকা প্রস্তুত, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দল নিবন্ধন, নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া দলের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা, ব্যালট পেপার প্রস্তুতসহ আরও কিছু বিষয় যুক্ত থাকবে বলে জানান ইসি কর্মকর্তারা। এসব বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণের পর ঘোষণা করা হবে নির্বাচনের তফশিল।
কবে তফশিল ঘোষণা?
যেকোনো নির্বাচনের আগে সেটির একটি তফশিল ঘোষণা করে থাকে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বলেন, সেখানেই ভোটের জন্য নির্ধারিত দিনক্ষণ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। তবে দিন-তারিখ ছাড়াও প্রার্থীরা কবে থেকে মনোনয়ন সংগ্রহ ও জমা দিতে পারবেন, মনোনয়নের কাগজপত্র কতদিনের মধ্যে বাছাই করা হবে, কাগজ বাতিল হলে প্রার্থিতা প্রত্যাশী ব্যক্তিরা কতদিন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে আপিল করতে পারবে- এরকম খুঁটিনাটি আরও অনেক বিষয়ে তথ্য দেওয়া থাকে তফশিলে।
এছাড়া যারা প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাবেন, তাদের তালিকা কবে নাগাদ ছাপানো হবে, নির্বাচনি প্রচারণা কবে থেকে শুরু করা যাবে আর কতদিন পর্যন্ত তা চালানো যাবে, নির্বাচনের দিন কটার সময় ভোট শুরু হয়ে কতক্ষণ চলবে, ভোট শেষে কোথায়-কীভাবে ভোট গণনা করা হবে, তফশিলে সেটিরও উল্লেখ থাকে।
নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দেড় থেকে দুই মাস আগে সেটার তফশিল ঘোষণা করা হয়ে থাকে।
মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, এবারো সেটার খুব একটা ব্যতিক্রম হবে না।
বুধবার নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও একই কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন।
তিনি আরও বলেন, ভোটের যে তারিখ ঠিক হবে- তার দুইমাস আগে তফশিল ঘোষণা করা হবে।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরু হওয়ার আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। সেই হিসেবে আগামী ডিসেম্বর মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হতে পারে বলে বিবিসি বাংলাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা।
আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেক্ষেত্রে ওই সময়ে (ডিসেম্বরে) ঘোষণা হতে পারে।
অন্যান্য প্রস্তুতি কতদূর?
আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার তালিকা প্রস্তুত, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দল নিবন্ধন, নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া দলের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা, ব্যালট পেপার প্রস্তুত করাসহ যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন।
আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, এক্ষেত্রে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
এর আগে চলতি বছরের শুরুতে দোসরা মার্চে ভোটারদের তালিকা প্রকাশ করেছিল নির্বাচন কমিশন। সেখানে ১২ কোটি ৩৭ লাখেরও বেশি ভোটার দেখা গেছে।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওই তালিকাটি হালনাগাদ করা হয়েছে, যা প্রকাশ করা হবে আগামী ১০ অগাস্ট। সেখানে কেউ কোনো অভিযান তুললে সেটি নিষ্পত্তি শেষে ৩১ আগস্টের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ।
ভোটের আগে নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। ইতোমধ্যেই তারা ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানার খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে বাগেরহাট ও গাজীপুরসহ তিন ডজনেরও বেশি এলাকায় পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
আখতার আহমেদ বলেন, সীমানা নিয়ে আপত্তি থাকলে আগামী ১০ আগস্টের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। এরপর শুনানি শেষে আগস্টের মধ্যেই সীমানা চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এছাড়া ইতোমধ্যে সীমানা আইন সংশোধন অধ্যাদেশ, ভোটার তালিকা সংশোধন অধ্যাদেশ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা, স্থানীয় পর্যবেক্ষক নীতিমালা, বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম নীতিমালা, পর্যবেক্ষক সংস্থা নীতিমালা জারি ও আবেদন আহ্বান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
আজ এগুলো নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা চূড়ান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন আবেদন যাচাই-বাছাই করে সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে কমিশনকে। কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ১৪৫টি দলের নিবন্ধন আবেদন তাদের কাছে জমা পড়েছে।
এর মধ্যে তথ্য ঘাটতি চেয়ে চিঠি দেওয়ার পর ৮০টির মতো দল প্রয়োজনীয় নথি দিয়েছে। এছাড়া সময় বাড়াতে আবেদন করেছে ছয়টি দল। তফশিল ঘোষণার আগেই নতুন আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করে ভোটে অংশ নেওয়া দলের তালিকা প্রকাশ করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
এর বাইরে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ ও প্রস্তুত করা, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা, ব্যালট পেপার প্রস্তুতসহ অন্যান্য কাজও চলছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আখতার আহমেদ বলেন, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব ধরনের নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা শেষ হবে। লোকাল পারচেজ প্রকিউরমেন্টে আটটি আইটেম ছিল। তার ভেতরে একটিতে পুনরায় দরপত্র দিতে হয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমাদের যে সময়সীমা রয়েছে, তার মধ্যে পাওয়া যাবে।
এছাড়া এবার ভোটে অনিয়ম বন্ধে এবার নির্বাচনি কর্মকর্তা নিয়োগে নতুন কৌশল নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগে।
কোথাও কোথাও জেলা প্রশাসকদের পরিবর্তে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া হবে বলে সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন।
স্বদেশবিচিত্রা/এআর